বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগি পালন বর্তমানে একটি জনপ্রিয় এবং লাভজনক খামার ব্যবসা। তুলনামূলক কম সময়ে এবং স্বল্প বিনিয়োগে ভালো আয় পাওয়া যায় বলে অনেক উদ্যোক্তা, কৃষক এমনকি শিক্ষিত তরুণরাও এ খাতে ঝুঁকছেন। তবে লাভের পাশাপাশি এ খাতে নানান ধরনের ঝুঁকি রয়েছে, যেগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা না করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এই লেখায় বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ব্রয়লার মুরগি পালনের প্রধান ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. রোগবালাই ও মৃত্যু ঝুঁকি
ব্রয়লার মুরগি তুলনামূলকভাবে সংবেদনশীল। ছোটখাটো ত্রুটি হলে সহজেই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। নিউক্যাসল, গামবোরো, কক্সিডিওসিস, রানীক্ষেত, সালমোনেলা ইত্যাদি রোগ দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পুরো খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর ফলে হঠাৎ করে শতকরা ২০–৩০ শতাংশ মুরগি মারা যেতে পারে। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে সঠিক ভ্যাকসিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য।
২. বাজারদরের ওঠানামা
বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগির বাজারদর কখনও কখনও অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। এক মাসে কেজিপ্রতি ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠলেও আবার অন্য সময় ১৩০ টাকায় নেমে আসে। খামারিরা খাবার, ওষুধ ও শ্রমে নির্দিষ্ট খরচ করেন, কিন্তু বিক্রির সময় দাম কমে গেলে লোকসান হয়। বাজারদরের অস্থিরতা খামারিদের জন্য অন্যতম বড় ঝুঁকি।
৩. খাবারের খরচ বৃদ্ধি
ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচের প্রায় ৬৫–৭০ শতাংশ যায় খাবারের পিছনে। সয়াবিন, ভুট্টা ও ফিডের দাম বেড়ে গেলে সরাসরি উৎপাদন খরচ বাড়ে। বাংলাদেশে ফিডের দাম প্রায়ই ওঠানামা করে, যার ফলে পরিকল্পিতভাবে লাভ হিসাব করা কঠিন হয়। অনেক সময় খামারিরা খাবারের খরচ মেটাতে গিয়ে লোকসান করেন।
৪. পরিবেশ ও আবহাওয়া
বাংলাদেশ একটি গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার দেশ। গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমে মুরগির হিট স্ট্রোক হতে পারে। শীতে পর্যাপ্ত হিটিং না থাকলে ঠান্ডাজনিত রোগ দেখা দেয়। বজ্রপাত বা লোডশেডিংয়ের কারণে হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন হলেও মুরগির স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সঠিক পরিবেশ না থাকলে মৃত্যুহার বেড়ে যায়।
৫. ভেজাল ওষুধ ও ফিডের প্রভাব
অনেক সময় বাজারে নিম্নমানের ওষুধ, ভেজাল ভ্যাকসিন বা নিম্নমানের খাবার পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করলে মুরগি ঠিকমতো বাড়ে না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল পণ্যের কারণে খামারিরা অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির মুখে পড়েন।
৬. আর্থিক ঝুঁকি
খামার পরিচালনা করতে গিয়ে প্রাথমিক বিনিয়োগের পাশাপাশি মাসিক খরচ থাকে। খাবারের দাম বাড়া, বাজারদর কমে যাওয়া বা রোগের কারণে মৃত্যু হলে খামারিকে ঋণ নিতে হয়। অনেক সময় ব্যাংক ঋণ বা এনজিও ঋণের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে যায়। ফলে আর্থিকভাবে সংকটে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
৭. ব্যবস্থাপনার ঘাটতি
খামার পরিচালনায় অভিজ্ঞতা না থাকলে অনেক ভুল হয়। যেমন—
- সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন না দেওয়া
- খাবারের সঠিক মিশ্রণ না রাখা
- খামারের ভিতর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না করা
লিটার পরিবর্তন না করা
এই ছোট ছোট ত্রুটিগুলো বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। নতুন উদ্যোক্তারা অভিজ্ঞতার অভাবে প্রায়ই এসব সমস্যায় পড়েন।
৮. পরিবহন ও বিপণন ঝুঁকি
গ্রামাঞ্চলের খামার থেকে শহরে মুরগি আনা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়। পথে মুরগি মারা যাওয়া বা ওজন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার ব্যবসায়ীদের দামের কারসাজির কারণে খামারিরা ন্যায্য দাম পান না। ফলে আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
৯. প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা অতিবৃষ্টির কারণে খামারের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ফ্যান বা হিটারের কাজ বন্ধ হয়ে মুরগি মারা যেতে পারে। এসব অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ খামারিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
১০. সামাজিক ও আইনগত ঝুঁকি
অনেক এলাকায় খামারের দুর্গন্ধ নিয়ে স্থানীয় জনগণের অভিযোগ থাকে। এতে সামাজিক বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। আবার সঠিক লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি বা আইনগত নিয়ম না মানলে জরিমানা বা খামার বন্ধের ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগি পালন লাভজনক হলেও ঝুঁকি কম নয়। রোগবালাই, বাজারদরের ওঠানামা, খাবারের খরচ বৃদ্ধি, আবহাওয়া ও পরিবেশগত সমস্যা, আর্থিক চাপ—সব মিলিয়ে খামারিদের সঠিক পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এগোতে হয়।
খামার থেকে ভালো আয় করতে হলে শুরুতেই ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা জরুরি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মানসম্মত খাবার ও ওষুধ ব্যবহার করা, বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং জরুরি অবস্থার জন্য বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করাই পারে খামারিকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে।
অতএব, ব্রয়লার খামারে ঝুঁকি থাকলেও সতর্ক পরিকল্পনা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে এই খাত থেকে উল্লেখযোগ্য আয় করা সম্ভব।
