বাংলাদেশে বর্তমানে হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামার একটি জনপ্রিয় এবং লাভজনক ব্যবসা। তুলনামূলক স্বল্প সময়ে ভালো আয় হওয়ার কারণে অনেক উদ্যোক্তা এ খাতে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে খামারের উৎপাদন টেকসই ও লাভজনক করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খামারকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। খামার পরিষ্কার না রাখলে বিভিন্ন রোগবালাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, মৃত্যুহার বেড়ে যায় এবং খামারিরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন। তাই খামারকে স্বাস্থ্যকর রাখতে নিয়মিত যত্ন ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা অপরিহার্য। নিচে খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রোগমুক্ত রাখার জন্য দশটি কার্যকরী উপায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. প্রতিদিন ঝাড়ু ও ময়লা অপসারণ
খামারের ভেতর প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে খাবারের উচ্ছিষ্ট, পালক, মল এবং ময়লা সরাতে হবে। মুরগি বা গবাদি পশুর মল জমে থাকলে তাতে গ্যাস ও দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় যা শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি রোগ ছড়াতে পারে। তাই প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার করার অভ্যাস তৈরি করা খামারের জন্য সবচেয়ে মৌলিক কাজ।
২. লিটার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা
বিশেষ করে মুরগির খামারে লিটার (কাঠের গুঁড়া, ধানের কুঁড়া বা চালের খোসা) শুকনো ও পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভেজা লিটারেই কক্সিডিওসিসসহ নানা রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদি লিটার ভিজে যায়, তাহলে তা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া সপ্তাহে একবার লিটার নাড়াচাড়া করলে তা শুকনো থাকে এবং দুর্গন্ধও কমে।
৩. পানির পাত্র পরিষ্কার রাখা
খামারের পানির পাত্র প্রতিদিন ধুয়ে পরিষ্কার পানি দিতে হবে। অনেক সময় পাত্রে শৈবাল বা ময়লা জমে যায়, যা পানির গুণগত মান নষ্ট করে। এর ফলে মুরগি বা গবাদি পশুর পেটের রোগ দেখা দিতে পারে। তাই প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে পানির পাত্র ধুয়ে পরিষ্কার পানি দেওয়া উচিত।
৪. খাবারের পাত্র ধোয়া
খাবারের পাত্রে পুরনো খাবার জমে থাকলে তাতে ছত্রাক জন্মায় এবং ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। এর ফলে মুরগির বৃদ্ধি কমে যায় এবং হজমে সমস্যা হয়। তাই প্রতিদিন খাবারের পাত্র পরিষ্কার করা জরুরি। নতুন খাবার দেওয়ার আগে পুরনো খাবার ফেলে দিতে হবে।
৫. জীবাণুনাশক ব্যবহার
খামারের মেঝে, দেয়াল, খাঁচা ও সরঞ্জাম নিয়মিত অনুমোদিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন জীবাণুনাশক স্প্রে করলে খামার অনেকাংশে রোগমুক্ত থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, জীবাণুনাশক যেন প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর না হয়। সাধারণত খামার ফাঁকা থাকলে গভীরভাবে জীবাণুমুক্ত করা আরও কার্যকর হয়।
৬. বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা
খামারের ভেতরে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে গরম, আর্দ্রতা ও গ্যাস জমে যায়। এতে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। খামারে জানালা বা ফ্যান ব্যবহার করে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শীতে অতিরিক্ত ঠান্ডা বাতাস যেন সরাসরি প্রাণীর গায়ে না লাগে।
৭. বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলা
খামারের ভেতরে কোনো মৃত মুরগি বা পশু পড়ে থাকলে তা অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা জরুরি। সেগুলো মাটির নিচে চাপা দিতে হবে অথবা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফেলা উচিত। এছাড়া খামারের দৈনন্দিন বর্জ্য ও মলমূত্র আলাদা জায়গায় জমা করতে হবে যাতে খামারের ভেতরে দুর্গন্ধ না হয়।
৮. জুতা ও পোশাকের পরিচ্ছন্নতা
খামারে প্রবেশের সময় আলাদা জুতা ও পোশাক ব্যবহার করা উচিত। বাইরের জুতা দিয়ে খামারে প্রবেশ করলে বাইরের জীবাণু ভেতরে চলে আসতে পারে। অনেক সময় খামারে প্রবেশের আগে জুতার তলায় জীবাণুনাশক পানিতে ডুবিয়ে নেওয়া কার্যকর হয়। এতে রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
৯. খামারের আশপাশ পরিষ্কার রাখা
খামারের চারপাশের ঝোপঝাড়, নোংরা পানি বা আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ঝোপঝাড়ে ইঁদুর, সাপ ও মশার বসবাস বেড়ে যায়, যা খামারের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া নোংরা পানিতে মশা জন্মায় এবং আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তাই খামারের ভেতরের পাশাপাশি আশপাশও পরিষ্কার রাখা জরুরি।
১০. নির্দিষ্ট সময়ে গভীর পরিষ্কার
প্রতিটি খামার ব্যাচ শেষ হওয়ার পর খামার খালি করে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা উচিত। এ সময় খামারের মেঝে, দেয়াল, ফ্যান, পানির লাইন এবং সমস্ত সরঞ্জাম ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর অন্তত এক সপ্তাহ খামার খালি রেখে শুকিয়ে নেওয়া হলে নতুন ব্যাচে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
খামার পরিষ্কার রাখা শুধু রোগ প্রতিরোধের জন্যই নয়, বরং উৎপাদন ও লাভ বাড়ানোর জন্যও অপরিহার্য। প্রতিদিনের ছোট ছোট যত্ন, যেমন পানির পাত্র ধোয়া, লিটার শুকনো রাখা বা আশপাশ পরিষ্কার করা, খামারের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। অনেক সময় খামারিরা খাদ্য ও ওষুধে বেশি খরচ করেন, কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন না। অথচ এটি সবচেয়ে সহজ, কার্যকর এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতি খামারকে সুস্থ রাখার জন্য। তাই যে কোনো খামারিকে শুরু থেকেই খামারের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
